উপজেলা চেয়ারম্যানদের মন্ত্রণালয় বা সরকারের যে কোনো পর্যায়ে যোগাযোগ করতে হলে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমেই করতে হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এমন নির্দেশের পর চেয়ারম্যানরা ক্ষুব্ধ ও খুবই অসন্তুষ্ট। তারা অপমানবোধ করছেন। তারা বলছেন, সব সময় যেখানে সরাসরি যোগাযোগ সেখানে কেন আজ এই আদেশ? এতে মাঠ প্রশাসনে ইউএনও-চেয়ারম্যান মুখোমুখি অবস্থানে।
ইউএনওদের মুখ্য কর্মকর্তা উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আদেশ জারির পাশাপাশি চেয়ারম্যানদের গাড়ির ব্যবহার নিয়েও পৃথক আরেকটি অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে। এ নিয়েও উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। চেয়ারম্যানরা বলছেন, শুধু তাদের ক্ষমতাই খর্ব করা হলো না, এসব আদেশ জারি করে তাদেরকে অপমানও করা হচ্ছে।
উপজেলা চেয়ারম্যানরা বলছেন, দেশের প্রায় সব উপজেলা পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যান রয়েছেন। তবু প্রশাসন সব বিষয়ে ছড়ি ঘোরাতে চাইছে। চেয়ারম্যানদের কাজ করার কোনো সুযোগই দেওয়া হচ্ছে না। বরং হাত-পা বেঁধে দেওয়ার মতলবে একের পর এক অফিস আদেশ আরোপ করা হচ্ছে। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামকে জানানোর পরও এসব সমস্যার প্রতিকার হচ্ছে না। বরং আমলাতন্ত্র মাঠ পর্যায়েও শিকড় গেড়ে বসেছে। সূত্র জানান, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপজেলা-১ শাখা উপসচিব নুমেরী জামানের স্বাক্ষরে ২৯ জানুয়ারি একটি অফিস আদেশ জারি হয়। এতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের উপজেলা পরিষদের ‘মুখ্য নির্বাহী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই আদেশে বলা হয়েছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা মুখ্য নির্বাহী হিসেবে উপজেলা পরিষদসংক্রান্ত যাবতীয় পত্রালাপ করবেন। অর্থাৎ উপজেলা চেয়ারম্যানরা যদি জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয় থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারের অন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা দফতরে যোগাযোগ করতে চান তাহলে সেটা করতে হবে ইউএনও অর্থাৎ মুখ্য নির্বাহীর মাধ্যমে
সরাসরি তারা (উপজেলা চেয়ারম্যানরা) কোনো চিঠি আদান-প্রদান করতে পারবেন না। চেয়ারম্যানরা বলছেন, উপজেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন চেয়ারম্যান। তিনি কোথায় কার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করবেন সেটা তার এখতিয়ার। সেখানে ইউএনওকে মুখ্য নির্বাহী করে পত্রালাপ তার মাধ্যমে করার ব্যবস্থা কার্যত উপজেলা চেয়ারম্যানের কর্মক্ষেত্র সংকীর্ণ করে দেওয়া। স্থানীয় সরকার বিভাগের উপজেলা-১ শাখা গত ৬ ফেব্রুয়ারি আরেকটি অফিস আদেশ জারি করে উপজেলা চেয়ারম্যানদের নামে বরাদ্দকৃত জিপ গাড়ির ব্যবহার বিষয়ে। ওই আদেশে বলা হয়েছে, বরাদ্দকৃত এসব জিপ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া নিজ উপজেলা বা জেলার বাইরে ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। বিনা অনুমতিতে নিজ উপজেলা বা জেলার বাইরে ব্যবহার হয়েছে প্রতীয়মান হলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা চেয়ারম্যানকে এর দায় গ্রহণ করতে হবে এবং উপজেলা আইন, ১৯৯৮-এর ১৩ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ দুটি অফিস আদেশ সারা দেশে উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষুব্ধ করেছে। বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দুমকী উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ হাওলাদার বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংসদে পাস করা আইন কার্যকরের পরিবর্তে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা নির্বাচিত পরিষদকে নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে শুধু আইনকে অকার্যকর করছেন না, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও অমর্যাদা করছেন। বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থাকে বিতর্কিতও করছেন। ’ বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মনোহরদী উপজেলা চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম খান বীরু গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চেয়ারম্যানরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সব সময় তারা সরাসরি মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছেন। এখন হঠাৎ করে সেখানে ইউএনওকে মুখ্য নির্বাহী করে বলা হচ্ছে পত্রালাপ করতে হবে তার মাধ্যমে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা খর্ব করা এবং তাদেরকে অপমান করা হচ্ছে। ’ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘গাড়ি ব্যবহারের চিঠি দিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যানদের আরেক দফা অপমান করা হয়েছে। ইউএন বা ডিসিকে তো এ রকম কোনো চিঠি দেওয়া হচ্ছে না। এটা প্রশাসনের দ্বৈতনীতি। ’ তিনি বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে চেয়ারম্যানদের শাসন করা হচ্ছে; যা মোটেই কাম্য নয়। ’ তিনি বলেন, ‘ইউএনও, ডিসি, উপজেলা চেয়ারম্যান সবাই কিন্তু সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন। আর চেয়ারম্যানরা জানেন তাদের ক্ষমতা কতটুকু। এজন্য চিঠি দেওয়ার দরকার নেই। উপজেলা চেয়ারম্যানরা দায়িত্বজ্ঞানহীন নন। তা ছাড়া ইউএনও এবং ডিসিরা তো দু-তিন বছর একটি এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন। তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু চেয়ারম্যানরা জনপ্রতিনিধি। তাদেরকে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়ারও চিন্তা করতে হয়। চেয়ারম্যানদের অনেক দায়বদ্ধতা। ’ এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গাড়ির অপব্যবহার হচ্ছে। সুতরাং অপব্যবহার রোধ করা দরকার। এটা শুধু উপজেলায় নয়, সরকারের সব স্তরে গাড়ির অপব্যবহার হচ্ছে। তা নিয়ে কিছু করা হচ্ছে না। ’ তিনি বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যানদের গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নীতিমালা আছে। সেটা থাকার পর নতুন করে চিঠি দেওয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই। ’ইউএনওকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘উপজেলা পরিষদে সচিব কে? কোনো সচিব নেই। আপনি যখন ইউএনওকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা উল্লেখ করে চিঠি দিলেন তাহলে সেখানে উল্লেখ করা উচিত ছিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে? তা করেননি। চেয়ারম্যান হচ্ছেন পরিষদের প্রধান নির্বাহী। ’ তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলা পরিষদে সচিব দিলেই সমস্যার অনেক সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু তা করা হচ্ছে না। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও ইউনিয়নে সচিব আছে। কিন্তু উপজেলায় নেই। এগুলো আগে ঠিক করতে হবে। ’ তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যানকে পাশ কাটিয়ে উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটিতে ইউএনওকে সভাপতি করা হয়েছে। কিন্তু কেন? এখানে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের কোনো কাজ নেই!’